WELCOME TO NANDAIL NEWS - REFLECTION OF TIME - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ -সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ -সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি

Thursday, February 16, 2012

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সম্প্রসারণ
সংস্কৃতি একটি বিচিত্র মাত্রিক শব্দ। একটি সমাজের সার্বিক পরিচিতি, আচার-আচরণ, তাদের আবহমান ঐতিহ্য, অভ্যাস, রীতি-নীতি ইত্যাদির সমন্বয়ে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সেজন্যে মানব সমাজকে জানতে হলে বা বুঝতে হলে তাদের সংস্কৃতিকে ভালোভাবে বোঝা প্রয়োজন। সংস্কৃতি আসলে একটি সমাজের মৌলিক পরিচিতি দান করে। সংস্কৃতির যতোরকমের সংজ্ঞা এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ধর্ম, ইতিহাস, ভূগোল, রীতি-পদ্ধতি,জেনেটিক ও মনিাবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সহ আচার-ব্যবহারের আদর্শ ইত্যাদি সবকিছুই সংস্কৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে।

সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি সংজ্ঞা যাতে আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো প্রতিফলিত হয়েছে, ১৯৮২ সালে তা নিরূপণ করা হয়েছে। এ বছর সাংস্কৃতিক নীতি সংক্রান্ত বিশ্ব কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল ম্যক্সিকোতে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল দেশ ও সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ঐ ম্যাক্সিকোসিটি ঘোষণায় সাংস্কৃতিক নীতিমালা সম্পর্কে বলা হয়েছে:একটি সমাজের বিচিত্র মানুষের আত্মিক ও বস্তুতান্ত্রিক তারতম্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য,তাদের চিন্তা-চেতনা,তাদের অনুভূতিগত বৈচিত্র-ইত্যাদি সবকিছুর সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি। যেমনটি একটু আগেও বলেছিলাম যে, সংস্কৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবনের বিচিত্র অবস্থা, মানুষের মানবিক অধিকার, তাদের মূল্যবোধের ধারা, তাদের আবহমান ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ইত্যাদি। ঐ ঘোষণার অপরাংশে এসেছে: আশেপাশের পৃথিবীর ব্যাপারে মানুষের মাঝে যেসব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সংস্কৃতি সেগুলোকে দিক-নির্দেশনা দেয় এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যগুলোকে সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলে। সংস্কৃতি মানুষকে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ জীবন দান করে, বিবেচনা শক্তি দেয় এবং মানুষের মাঝে নৈতিকতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সংস্কৃতির মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধের শিক্ষা পাই এবং নিজেকে অন্যদের মাঝে পরিচিত করে তোলার সুযোগ পাই কিংবা নিজেদের মধ্যকার সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করার সুযোগ পাই। এই সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী সংস্কৃতি একটি সমাজের নির্দিষ্ট স্বরূপ নির্নয় করে এবং মূল্যবোধ, বিশ্বাস, শিল্প-সাহিত্য এবং সাধারণ আচার-আচরণ পদ্ধতিগুলোর উপাদান গঠনে সহযোগিতা করে।

এই যে মূল্যবোধের কথা বলা হলো, এই যে ঐতিহ্যের কথা বলা হলো, এগুলো শিল্পের বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং ধীরে ধীরে সবার কাছে পরিচিত হয়ে পড়ে। এভাবেই একটি জাতির শিল্প, তাদের ঐতিহ্য ও রীতি-আচারগুলোর সাথে পরিচিত হবার প্রভাবশালী একটি মাধ্যমে পরিণত হয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতির স্বরূপকে অনুভূতিগ্রাহ্য এবং অনুভূতিহীন-এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। ভাষা, সাহিত্য, মিউজিক, খেলাধুলা, রূপকথা, ধর্মবিশ্বাস ও নিয়মনীতি, আচার-প্রথা, জ্ঞান, শিল্প, স্থাপত্য এবং অপরাপর শিল্প-ইত্যাদি হলো একটি জাতি বা গোত্রের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধগুলোর পরিচয় তুলে ধরার প্রকৃত মাধ্যম। সাংস্কৃতিক পরিচয়টা যদি আঞ্চলিক এবং জাতীয় ধর্মবিশ্বাসের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয় তাহলে সেই সংস্কৃতি অনেক বেশি ঔজ্জ্বল্য পায়। এরই ভিত্তিতে বলা যায় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হচ্ছে প্রকৃতির অনন্য এক উপহার এবং প্রত্যেক জাতিরই অধিকার রয়েছে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা।
কেননা বিশ্বের মানব সমাজের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে তেমনি মানব সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। আর সাংস্কৃতিক এই বৈচিত্রের কারণেই জন্ম নিয়েছে বিত্রচি ভাষা, বিচিত্র পোশাক-আশাক আর বিচিত্র আচার-প্রথা। আসলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মানব জীবনে সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার প্রয়োজনীয়তার কথাই তুলে ধরে । আর এভাবেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে মানুষের উত্তরাধিকার।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিষয়টি নতুন নয়। এই পৃথিবীর বুকে মানুষের দীর্ঘ জীবনযাপনে এবং তাদের পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন গোত্রের, সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন বর্ণের, সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির। ইতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে এইসব সংস্কৃতির একটির সাথে আরেকটির সংযোগ ছিল। সেইসাথে পারস্পরিক প্রভাবের কারণে একটির জন্যে আরেকটি ছিল অপরিহার্য। কিন্তু অধিকার সনদের একটি কাঠামোয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের যে প্রস্তাব বা ঘোষণা এবং সমগ্র বিশ্বে তাকে গ্রহণ করার ওপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ সেটা একেবারে নতুন একটি চিন্তা। কেননা এই সনদে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে মানুষের অভিন্ন উত্তরাধিকার বা ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাকে বস্তুত একটি ইতিবাচক সাংস্কৃতিক আচরণ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই বিষয়টি বিশ্বায়ন চিন্তা বা গ্লোবালাইজেশন চিন্তা এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে একটি সংস্কৃতির মাঝে বিলীন করে দেওয়ার মতো চিন্তার বিপরীতে দাঁড় করানো হলেও আসলে এর লক্ষ্য হলো স্থানীয় সংস্কৃতিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তার করা।
সত্তরের দশকে উত্থাপিত গ্লোবালাইজেশন চিন্তাটি পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে উত্থাপিত একটি প্রকল্প যার মাঝে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি-সবই অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বায়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এইসব চেষ্টা প্রচেষ্টার একটি হলো পুঁজিবাদী দেশগুলোর মাধ্যমে তথ্য উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী তার স্থানান্তর। বিশ্বায়ন বিষয়টি পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর বিশ্বের অন্যান্য দেশের দক্ষতা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। এর মাধ্যমে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর লক্ষ্য হলো এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অন্যান্য দেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ করে দেওয়া এবং সময়ের বিবর্তনে তাকে গতিহীন করে দেওয়া। একটি ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে চালু করা এবং শক্তিধর দেশগুলোর সংস্কৃতিকে উন্নত সংস্কৃতি হিসেবে তুলে ধরার জন্যে গণমাধ্যম এবং শিল্পমাধ্যমগুলোকে কাজে লাগানো-এসবই বিশ্বব্যাপী একক বা অভিন্ন সংস্কৃতি বিস্তারের লক্ষ্যে পুজিঁবাদী ব্যবস্থার অন্যতম একটি পদক্ষেপ।
টি দাদ কিউনেল নামক ইউরোপীয় এক লেখক ইন্টারনেট শিরোণামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সংস্কৃতির ওপর বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের প্রভাব সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, অর্থবহুল পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্র শিল্প এবং তাদের টিভি অনুষ্ঠানমালা- অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারগুলোতে এগুলোর সীমাহীন প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে এসব দেশের সাংস্কৃতিক যে সক্ষমতা রয়েছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সেগুলোর মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক শক্তিকে মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে বিদেশী সাংস্কৃতিক পণ্য আমদানী করাটা অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদনের তুলনায় সস্তা। সে কারণেই এগুলোর আমদানী বেশি। আর এভাবেই বিদেশী সংস্কৃতি, বিদেশী চিন্তাদর্শ, নীতি-নৈতিকতার আধিপত্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এ বিষয়টির প্রতিই সতর্কতার সাথে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে গত ২১ মে ' অনুষ্ঠিত অগ্রগতি ও সংলাপের জন্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য শীর্ষক বিশ্ব দিবসের সম্মেলনে।
২.
আমরা সবাই জানি যে এই বিশ্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা, মাযহাব এবং রীতিনীতি ইত্যাদি দিক থেকে বৈচিত্রপূর্ণ। তাই সকল সংস্কৃতির প্রতিই সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। লক্ষ্য করা উচিত বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের দিক থেকে কী রকম? আচ্ছা বিশ্বের দেশগুলো কিংবা শাসন ব্যবস্থাগুলো কি সংস্কৃতির সম্প্রসারণ বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্রগুলো সংরক্ষণ করার জন্যে প্রয়োজনীয় চেষ্টা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে? বাস্তবতা হলো সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে কয়েকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে বলা যায় সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ইস্যুটি বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোর ঘটনায় ব্যাপক ভূমিকা বা প্রভাব ফেলেছে। কখনো কখেো গোত্রীয় সংঘাতকে বা বর্ণগত বৈষম্যকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে উশকে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বলকান অঞ্চল বা আফ্রিকার কোনো কোনো অঞ্চলসহ বহু অঞ্চলে কোনো একটি সংস্কৃতি এবং গোত্রকে নির্মূল করে ফেলার জন্যে বিগত দশকগুলোতে বংশ নিধন অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র সংরক্ষণের মধ্যে বহু ইতিবাচকতা রয়েছে। কেননা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা বিশ্বে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অটুট থাকার জন্যে খুবই জরুরি একটি বিষয়। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় বিভিন্ন দেশ-জাতি ও সংস্কৃতি এবং বিশ্বের জীবিত ভাষাগুলোর যে উত্তরাধিকার, সেইসাথে যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থান বিশ্ব তালিকায় স্থান পেয়েছে সেগুলোকেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বা ঐতিহ্য বলা হয়। সে কারণে বিশ্বের এইসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলোকে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। এমতাবস্থায় আজকের এই ডিজিটাল বিশ্বে বিভিন্ন রকমের নিয়ম-কানুন বা রীতি পদ্ধতি রয়েছে, অতীতের নিয়ম-কানুনের সাথে যেগুলোর তুলনাই চলে না। তথ্য বিস্ফোরণের এই যুগে বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যকার ভৌগোলিক দূরত্ব এখন নেই বললেই চলে। তাই বিভিন্ন দেশ-জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পারে পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে মানব সংস্কৃতিকে দৃঢ়তা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে।
পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এখন এমন রব উঠেছে যার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। যেমন বলা যায় গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী একটি পরিভাষা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিভাষাটি হলো ‘ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে' বা তথ্যের মহাসড়ক এবং তথ্যের অবাধ চর্চা বা প্রাপ্তি ইত্যাদি। কোন দেশ কোন জাতি কতোটা উন্নত তা নির্ধারণের একটা সূচক হচ্ছে এই দুটি বিষয়। এই পরিভাষাটিকে সাংস্কৃতিক মৌলিক কর্মসূচিগুলোর একটি মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ১৯৯২ সালে। চিন্তার বিনিময়ের পাশাপাশি অপরাপর দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা বা তাদের ওপর আধিপত্য করা এমনকি অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যেও এই পরিভাষাকে ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা বিষয়ক বিতর্কের কড়া সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তাদের ধারণা এই শ্লোগানটি একটি বর্ণচোরা শ্লোগান। এর বাইরের দিকটা সুন্দর কিন্তু এর ভেতরে বিশেষ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।
এই বিশেষজ্ঞমহলের একজন হলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হার্বার্ট শিলার। তিনি বলেছেন, তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতার তত্ত্বের মাঝে বহুজাতিক বা বৃহৎ কোম্পানিগুলোর স্বার্থ উহ্য রয়েছে। আর এই পরিভাষাটি কেবল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে এক ধরনের ধোকা। তাঁর এবং তাঁর মতো যাঁরা অভিন্ন চিন্তার অধিকারী তাদেঁর এই পূর্বাভাস একান্তই বাস্তব ছিল। কেননা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতার ধারণাটিকে ঘিরে একটি নতুন আইন প্রণীত হয় যে, যার ফলে গণমাধ্যমের কর্মতৎপরতা এবং মালিকানার বিষয়টি নিয়ে গোলমাল পাকিয়ে যায়। আমেরিকার গণমাধ্যম বিষয়ক কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক কোম্পানি বিশ্ব তথ্য বাজারের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। বর্তমানে সাতটি বৃহৎ কোম্পানি যোগাযোগ বিষয়ক সরঞ্জামাদির বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে-ডিজনি, ওয়ার্নার ব্রাদার্স, সনি, নিউজ কর্পোরেশন, ভিয়া কম, ভিওনডি, ভার্টেলসম্যান। মার্কিন বুদ্ধিজীবি মিঃ ম্যাক চেচনি এই কোম্পানিগুলোকে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট বলে অভিহিত করেছেন।
এই কোম্পানিগুলো সকল সংস্কৃতির মধ্যকার ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলে এক কাতারে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক খবরাখবর বা ঘটনাচক্র কিংবা সংবাদ সরবরাহের কাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এইসব কোম্পানির গণমাধ্যমগুলোর যে কেন্দ্র রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের সকল ঘটনা বা খবরাখবর তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর বাইরে যেসব দেশ রয়েছে তাদেরকে প্রান্তদেশীয় বলে অভিহিত করা হয়। এদের কাছে প্রান্তীয় দেশগুলো খুবই তুচ্ছ এবং গুরুত্বহীন। পশ্চিমা তথ্য সমাজের পরিসংখ্যানের ওপর সংক্ষিপ্ত নজর বুলালে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাবে সংস্কৃতিগুলোর মধ্যকার ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলার জন্যে তারা কী পরিমাণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী গত দুই দশকে সাংস্কৃতিক পণ্যগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চার গুণ বেড়ে গেছে।
এই সাংস্কৃতিক পণ্য সামগ্রির মধ্যে রয়েছে বই, বিভিন্ন প্রকাশনা, মিউজিক প্রোডাকশন্স, মূর্ত শিল্প, চলচিচ্চত্র শিল্প, রেডিও-টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালা, কম্পিউটার গেইম্‌স, ক্রীড়া সরঞ্জামাদি ইত্যাদি বিনিময়ের হার আগের তুলনায় অন্তত চার গুণ বেড়েছে। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করছে আমেরিকা সাংস্কৃতিক পণ্যসামগ্রী যে পরিমাণ রপ্তানী করছে, তার পরিমাণ মেশিন তেরী শিল্প, কৃষি সরঞ্জাম, প্রতিরক্ষা ও স্পেইস সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি রপ্তানীর পরিমাণের চেয়ে বেশি। ১৯৮০'র দশকে হলিউডের হাতে বিশ্ব ফিল্ম প্রোডাকশনের ৩০ শতাংশ আয় ছিল। বর্তমানে এর পরিমাণ বেড়ে দাড়িয়েঁছে ৫০ শতাংশে। অথচ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানীর পরিমাণ একেবারেই কম। একদিকে এই উৎপাদন স্বল্পতা, অপরদিকে আমদানীকৃত পণ্যের বাহ্যিক আকর্ষণ বা চাকচিক্য-এসবের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণ আমদানীকৃত পণ্যের ব্যবহারের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আফ্রিকা মহাদেশ বাইরের ফিল্ম বিশেষ করে আমেরিকা ফিল্ম আমদানী করে প্রচুর পরিমাণ। পশ্চিমা দেশগুলো বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন করে থাকে,আর উন্নয়নশীল দেশগুলো সেগুলো ব্যবহার করে থাকে। ফলে এই তত্ত্বটি উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে যারা সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন করে,তাদেরই স্বার্থ নিশ্চিত করছে।
৩.
আপনারা নিশ্চয়ই সম্প্রসারণ বা উন্নয়ন পরিভাষাটির সঙ্গে পরিচিত। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানব উন্নয়ন তথা সচেতন এবং বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ প্রদান উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। উন্নয়ন ক্ষেত্রে সংস্কৃতির নাম নেওয়া মানে একটি সমাজের জনগণের জন্যে উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করা। সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কয়েকটি মূলনীতি রয়েছে। সার্বজনীন প্রশিক্ষণমূলক উন্নতি, সবার মাঝে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব, সামগ্রিক যোগাযোগ সরঞ্জামের উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর উন্নতি।
ইউনেস্কো ‘সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য' সম্পর্কে বিশ্ব ঘোষণায় উন্নয়নের জন্যে সাংস্কৃতিক নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের জাতীয় উন্নয়নকে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কেন্দ্রিক স্থাপন করার চেষ্টা করেছে। ঐ ঘোষণায় সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য, সকল সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন, কয়েক সংস্কৃতিবহুল সমাজে পারস্পরিক সংহতি দৃঢ় করা এবং আধ্যাত্মিক ও বস্তুতান্ত্রিক-সকল ঐতিহ্য সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণ করা এবং সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোর চোরাকারবার বন্ধ করার ওপরও এই ঘোষণায় ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০০১ সালে প্রণীত এই ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, যেই বিশ্বে অন্তত দশ হাজার মানব সমাজ দুই শ' টির মতো দেশের সীমান্ত নিয়ে একত্রে বসবাস করছে, সেখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বলতে বোঝায় সকল মানুষ, সকল জাতি ও গোষ্ঠির মানবিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষিত থাকা। কিন্তু বিশ্বের দেশগুলোর সাংস্কৃতিক নীতি কি এই নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে? সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা গেছে বিভিন্ন সমাজে বাস্তবায়িত নীতিমালা ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউনেস্কো ঘোষণায় সংখ্যালঘুদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করা, তাদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান পালন করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই ব্যক্তি স্বাধীনতা পশ্চিমা সমাজে কোথাও কল্পনাও করা যায় না। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসী যারা তাদেরকে পশ্চিমাদের সংস্কৃতির চাপের মুখে থাকতে হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকার দেশগুলোতে যেসব অভিবাসী আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ কিংবা এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যায় তারা যদিও সংখ্যালঘু তবুও আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী অন্যান্য নাগরিকের মতো তাদেরও সমান অধিকার থাকা উচিত। অথচ অবস্থা এমন যে তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম এমনকি ভাষা পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোতে মারাত্মক হুমকির শিকার। ছোট্ট একটি উদাহরণই যথেষ্ট, পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম মেয়েদের বিশেষ করে মুসলমান ছাত্রীদের ধর্মীয় পর্দাপ্রথার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে,তা এক কথায় চরম বৈষম্যমূলক এবং আন্তর্জাতিক নীতির পরিপন্থী। মজার ব্যাপার হলো, যারা বিভিন্ন দেশ ও জাতির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার দাবীদার তাদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে এই বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নের জন্যে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে? এই প্রশ্নটি যে কারো মনেই জাগতে পারে।
প্রশ্নটির জবাবে বলা যায়, এ পর্যন্ত পর্যালোচনায় যা লক্ষ্য করা গেছে তাতে মুসলিম দেশগুলোর সংস্কৃতি মন্ত্রীদের বৈঠকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা বা ও আই সি'র সাংস্কৃতিক, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক ইসলামী সংস্থা আইসিসকো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে একটি ঘোষণা বা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ঐ ঘোষণায় বিভিন্ন দেশ ও জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া, তাদের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক সহযোগিতা, বিভিন্ন দেশের মাঝে গঠনমূলক আলোচনা বা সংলাপ ইত্যাদি কর্মসূচিকে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায় বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এই ঘোষণায় এসেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা অনুগ্রহ। আর আমরা মুসলমান হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মানবিক দায়িত্বপ্রাপ্ত।
প্রত্যেক সংস্কৃতি আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং মূল্যবোধে সমৃদ্ধ। কারো পক্ষেই সম্ভব নয় বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে বিভিন্ন সংস্কৃতির ভূমিকাকে গোপন রাখে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মূল্যবান ও বৃহৎ এক সম্পদ। এই সম্পদ কারো বিরক্তি, অসংলগ্নতার কারণ যেমন হওয়া উচিত নয় তেমনি তাকে প্রত্যাখ্যানও করা উচিত নয়। উল্টো বরং যৌথ সহযোগিতা বিস্তারের উপায় বা হাতিয়ারে পরিণত হওয়া উচিত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সংহতি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি এবং বিভেদ বা মতানৈক্য পরিহারের উপায় হওয়া উচিত।
এই ঘোষণায় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ইসলামের শিক্ষার ভিত্তিতে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে এটাকে মানব অধিকারের মৌলিক ভিত্তির অন্যতম একটি দিক বলে ইসলাম মনে করে। কেননা ইসলাম ও কোরানের দৃষ্টিতে মানুষের মানব ভিত্তিগুলোর মধ্যকার পার্থক্য সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ব্যাপার এবং এই পার্থক্যগুলো স্রষ্টার সৃষ্টি ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। জ্ঞানী লোকদের জন্যে এতে রয়েছে শিক্ষার বহু উপাদান। পবিত্র কোরআনের সূরা রুমের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "তাঁর আরো এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।"
প্রতিটি ব্যক্তিই মানুষ হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি এবং সবাই সমান, কেউ কারো ওপরে নয়,তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে তাদের মর্যাদার তারতম্য ঘটে।