ছোটবেলার পহেলা বৈশাখের দিনগুলো
আজও পিছু ডাকে আমায় - সুফিয়া বেগম,
কথা সাহিত্যিক
বৈশাখ মানেই বাঙালী। বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতি মানেই
পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মানেই একরাশ হতাশা আর ব্যর্থতার পাহাড় ডিঙিয়ে প্রাণের উচ্ছ্বাসে বাঙালীর ভেসে যাওয়া। গ্রাম থেকে শহর-প্রান্তরের
প্রতিটি আনাচে-কানাচে বৈশাখের আগমনে প্রাণের জোয়ার জাগে বাঙালীর জীবনে। শহর কিংবা গ্রাম যে কোন পটভূমিতে
আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে ভিন্ন মাত্রিক আঙ্গিকতা পরিলতি হলেও প্রাণের উন্মাদনা
সবার জন্য এক। দিন বদলের সাথে সাথে আধুনিকতার হাত ধরে অনেক পরিবর্তন এসেছে বাংলা নববর্ষ পহেলা
বৈশাখ উদযাপনে। তবে শহুরে সভ্যতার বর্ণিল ছোঁয়া তেমন করে গ্রাস করে নিতে পারেনি গ্রামীণ আটপৌরে
জীবনের বৈশাখী আয়োজনকে। আজও আমাদের গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় বিশ/তিরিশ
বছর আগেকার পুরাতন গতিময়তায়।
রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান
নগরগুলোতে প্রতি বছর নানা বর্ণিল আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। প্রাণের টানে বয়সের পিছুটানকে
উপো করে প্রতি বছর চেষ্টা করি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু ছোটবেলায় আব্বার হাত
ধরে বটতলায় বা নদীর তীরের বৈশাখী মেলায় যাবার স্মৃতি কিছুতেই ভুলবার নয়। ঢাকায় বৈশাখ উদযাপনের সব বর্ণাঢ্য
আয়োজন যেন এর কাছে ম্লান হয়ে যায়। তাই বৈশাখের আগমন মুহূর্তে আমার ভিতর স্মৃতির পাপড়িরা ডানা মেলতে
শুরু করে। ভুলতে পারিনা চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন থেকে মা-চাচী-দাদীদের ব্যস্ততার কথা। বৈশাখকে ঘিরে তখনকার আটপৌরে
গ্রামীণ জীবনের ভিতর বাড়ির দৃশ্য ছিল এমনি। মা-চাচীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন চৈত্র সংক্রান্তির দিন আর পহেলা
বৈশাখের দিনের খাবার আয়োজন নিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সব ধরনের শাক খাওয়ার রীতিটা ছিল বহুদিনের
প্রচলিত প্রথা। বিগত বছরের সমস্ত জরা-ব্যধি দূর হয়ে যাবে-এই বিশ্বাসে প্রচলিত-অপ্রচলিত সব ধরনের
শাকের সমাহার ঘটত চৈত্র সংক্রান্তির দিনের দুপুরের খাবারে। তার সাথে চলত ঘর-বাড়ি ঝাড়-মোছের
কাজ। বিদায়ী বছরের সমস্ত ধুলো-বালি-ময়লা-আবর্জনা
দূর করে ঝকঝকে-তকতকে করে তোলা হতো বাড়িঘর। যাতে বৈশাখের আগমন ঘটে সূচী-শুভ্র-পবিত্রতার মধ্য দিয়ে।
মা-চাচীদের এই ধরনের আয়োজন
আমাদের অর্থাৎ ছোটদের মনে বৈশাখকে ঘিরে বাড়তি উদ্দীপনা জাগিয়ে দিত। পরের দিন পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন। জমবে বৈশাখী মেলা। এর আগাম আনন্দবার্তা নিয়ে আসত
চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি। সারারাত উদ্দীপনায় আমাদের ঘুম হতোনা। যেমনটি হতো চাঁদ রাতের বেলায়। অপোয় থাকতাম কখন রাত পোহাবে। বৈশাখী মেলায় যাব। হাতি-ঘোড়া-পুতুল কিনব। সবচেয়ে মজা পেতাম খাওয়ার হাতি-ঘোড়া
কিনতে পেরে। আমাদের দেশে এগুলোকে বলে সাজি। সাজি কিনতে না পারলে মনে হতো মেলায় যাওয়াটাই বৃথা গেল। সাথে কিনতাম বিন্নি ধানের খৈ। আর কিনতাম মাটি দিয়ে বানানো
রং বেরং এর পুতুল, বাঁশী, আরও নানা ধরনের খেলনা।
বৈশাখের সকাল বেলাতেই রান্নাঘরে
দেখতাম আম্মার অন্যরকম ব্যস্ততা। নানা রকম পিঠে দিয়ে নাস্তা হবে। এখনকার মতো সকালবেলা পান্থা-ইলিশ
দিয়ে নাস্তা খাওয়ার রীতি গ্রামে তখনও ছিলনা, এখনও নেই। নাস্তার পর দুপুরের খাবারের আয়োজনে লেগে যেতেন আম্মা। কারণ, পহেলা বৈশাখের দিনের দুপুরের
খাবার অন্যদিনের মতো গতানুগতিক হলে চলত না। সাধ্যমতো বছরের প্রথম দিনটিতে ভালো ভালো খাবারের আয়োজন চলত ঘরে
ঘরে। বিশ্বাস এই যে, পহেলা বৈশাখের দিন ভালো খাবার
খেলে সারা বছর এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অভাব আর দারিদ্রের নিস্পেষণে জর্জড়িত গ্রাম বাংলার মানুষের এই
বিশ্বাস কতটুকু ফলপ্রসূ হতো তা আজও জানার বাইরে রয়ে গেছে। তবে আজও গ্রামের মানুষ এই বিশ্বাসকে
আঁকড়ে ধরে আছে বৈশাখী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। আজকাল যেমন শহরে পহেলা বৈশাখ
উপলে নতুন কাপড় পড়ার প্রচলন দেখতে পাই তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে তো বটেই শহরেও এমনটি
ছিলনা। আমাদের গ্রামাঞ্চলের সেই আবহ এখনও বজায় থাকলেও পাল্টে গেছে শহুরে আনুষ্ঠানিকতা। আমরাও কখনও পহেলা বৈশাখ উপলে
নতুন পোশাকের জন্য বায়না ধরতাম না। আব্বা আমাদের চাহিদামতো সব ধরনের খেলনাপাতি ও খাবার জিনিস কিনে
দিতেন। তাই নিয়ে খুশীতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতাম আমরা। বাড়ি আসার পথে সেই কি দৃশ্য!
চোখের পর্দায় এখনও লেগে আছে যেন। মেলাফেরত মানুষের মিছিল। সব বাচ্চাদের হাত ভর্তি জিনিসপত্র। বাঁশীর প্যাঁ পোঁ শব্দে মুখর
হয়ে উঠত চারপাশ। বাড়ি ফিরেই বসে পড়তাম কার কোন খেলনাটা কত সুন্দর হয়েছে সেটা ঠিক করতে।
চাকুরীর ব্যস্ততার কারণে মাঝে
মাঝে আব্বা নববর্ষের দিন বাড়ি আসতে পারতেন না। তখন বাড়ির অন্যদের সাথে মেলায়
যেতাম আমরা। আম্মা দশ টাকা করে দিতেন আমাদেরকে। হাতে টাকা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তাম নিজে নিজে পছন্দের
জিনিস কিনতে পারব বলে। কত জিনিস যে কেনা যেত তখন দশ টাকায়! এখন ভাবলেও অবাক লাগে। মেলায় গেলে আর বাড়ি ফিরে আসতে
ইচ্ছে করত না। মনে হতো মেলাটা যদি আরও কিছুদিন থাকত তাহলে খুব মজা হতো। প্রতিদিন মেলায় যেতে পারতাম। ছোট্র মনে কেবলই প্রশ্ন জাগত
এত সুন্দর সুন্দর জিনিস নিয়ে কোথা থেকে আসে লোকগুলো? আবার কোথায় চলে যায় ? না গেলে কি হয় ?
আজ বহুদূর ফেলে এসেছি সেই পহেলা
বৈশাখের দিনগুলো। আমার মা-বাবা কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু মহাকালের চিরায়ত নিয়মে আজও বৈশাখ আসে। নববর্ষের উদ্দীপনায় মেতে উঠি
আমরা। শহরের কোলাহল মুখর ব্যস্ততায়
আমার মা-চাচীদের আটপৌরে আয়োজনে উদযাপিত পহেলা বৈশাখের দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারিনা। ভুলতে পারিনা সেই বটতলার কথা, নদী তীরের কথা। আমার কানে আজও বাজে সেই বাঁশীর
সুর। বৈশাখী মেলা থেকে কিনে যে বাঁশীর
সুরে চারদিক মাতিয়ে তুলতাম আমরা। আজ মনে হয় আমার প্রাণের নির্মল উচ্ছাসটুকু জড়িয়ে আছে বাঁশীর
সেই সুরের সাথে। তাই বৈশাখের আগমন মুহূর্তে ছোটবেলার কথা স্মরণ করে বুকের ভিতর অন্যরকম ভালো লাগার
অনুভবে আজও আলোড়িত হই আমি। আমার বুকের ওমে পরম আদরে পুষে রাখা সুখের ছোট্র সুখপাখী এটি। আমৃত্যু আমার মনে সুখের সরোবর
হয়ে বেঁচে থাকবে।